পারিবারিক সহিংসতা কাকে বলে? আইন অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা রোধের উপায়

পারিবারিক সহিংসতা : নারী ও শিশু নির্যাতন

 পারিবারিক সহিংসতা কাকে বলে?

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে ২০১০ সালে আইন প্রনীত হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ এর ধারা ৩ অনুযায়ী, পারিবারিক সহিংসতা বলতে "পারিবারিক সম্পর্ক রহিয়াছে এমন কোন ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোন নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং আর্থিক ক্ষতি বুঝাইবে।"

পারিবারিক সহিংসতা আইনের বৈশিষ্ট্য :

এই আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,  আইনটিতে জাতিসংঘের নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ ঘোষণা ১৯৯৩-এর ওপর ভিত্তি করে পারিবারিক সহিংসতার একটি স্পষ্ট সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সহিংসতামুক্ত ও স্বাধীনভাবে বসবাস করা প্রত্যেক নারীর অধিকার, সে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সহিংসতার শিকার নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাসস্থানের আদেশসহ অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ প্রদানের সুযোগ রয়েছে। আদালত দু’পক্ষের শুনানির পর প্রয়োজন মনে করলে সহিংসতার শিকার ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুরক্ষার আদেশ প্রদান এবং প্রদত্ত সুরক্ষার আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে পারবেন। এছাড়াও এই আইনটিতে ক্ষতিপূরণ, হেফাজত, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র এবং স্থানের ব্যবস্থা, নিভৃত-কক্ষ বিচার কার্যক্রম, বিনা খরচে আদালতের আদেশের কপি পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। বিলটিতে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার, প্রতিপালন কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করাসহ সেবা প্রদানকারি প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য করার বিধান রয়েছে।

পারিবারিক সহিংসতা আইন যাদের জন্য আইন প্রযোজ্য :

১। পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তি যিনি নারী অথবা শিশু হবেন; পারিবারিক সহিংসতা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিবন্ধী শিশু;

২। পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তি যার সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে।

৩। এদের পক্ষ হয়ে যে কেউ মামলা/অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।

৪। অভিযুক্ত পক্ষ পূর্ণবয়স্ক পুরুষ সদস্য যার সাথে সহিংসতার শিকার ব্যক্তির পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে;

৫। সহিংসতার শিকার নারীর স্বামী অথবা স্বামীর আত্মীয় নারী ও পুরুষ উভয় আত্মীয়ই হতে পারে।

পারিবারিক সহিংসতা থেকে উত্তরণের উপায় :

১। প্রথম শ্রেণীর ম্যজিস্ট্রেট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ অথবা অন্য কোনো আদেশ জারি করতে পারবেন;

২। এই আইনে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট প্রয়োগকারী কর্মকর্তা ও সহকারী প্রয়োগকারী কর্মকর্তা বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অভিযোগ গ্রহণের পর সহিংসতার শিকার ব্যক্তিকে চিকিৎসা সেবা, আইনগত সহায়তাসহ অন্য সেবাগুলো প্রাপ্যতা সম্পর্কে অবহিত করবেন।

পারিবারিক সহিংসতা মামলায় শাস্তির বিধান :

আইনটিতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনের মিশ্রণ ঘটেছে; আবেদনের ওপর ভিত্তি করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুরক্ষা আদেশ প্রদান করতে পারবেন; অভিযুক্ত ব্যক্তি আদেশ ভঙ্গ করলে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং গ্রেফতারপূর্বক জেলে প্রেরণ করতে পারবেন; ক্ষতিপূরণের ডিক্রি প্রদান করতে পারবেন;

আবেদনকারী আবেদন করার পর বিজ্ঞ আদালত আবেদনপত্রটি বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সুরক্ষা আদেশ ও নোটিশ প্রদান (৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানো) করবেন এবং পক্ষগুলোর মধ্যে শুনানির আয়োজন করে সুরক্ষা আদেশ (নোটিশ প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে) করবেন।

মামলার বিবাদী পক্ষ রায় প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে চীফ জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেট বা ক্ষেত্র অনুযায়ী চীফ মেট্রোপলিটন ম্যজিস্ট্রেট আদালতে আপিল করতে পারবেন। আদেশ অবমাননার শাস্তির বিধান বিবাদীপক্ষ সুরক্ষা আদেশ লঙ্ঘন করিলে উহা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ড অথবা ১০,০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। বিবাদী যদি একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটান সেক্ষেত্রে অনধিক ১২ মাস কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে ২০,০০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। এখানে উল্লেখ্য, অসত্য ও ভিত্তিহীন অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে।

আরও কিছু বিষয়:

ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে আদালত সহিংসতার শিকার ব্যক্তির আঘাত অথবা ক্ষতি অথবা লোকসানের প্রকৃতি বিবেচনা করে ন্যায্য ও যৌক্তিক ক্ষতিপূরণের আদেশ দেবেন। সন্তানের সুরক্ষার জন্য সুরক্ষা আদেশ অথবা দাবিকৃত অন্যান্য প্রতিকারের আবেদন শুনানির যে কোনো পর্যায়ে সহিংসতার শিকার ব্যক্তি অথবা আবেদনকারীর অনুকূলে সন্তানের হেফাজত প্রদান করতে পারবেন।

পারিবারিক সহিংসতা মামলার আপিল :

এই আইনে সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ আপিল করতে পারবেন। তবে ক্ষতিপূরণের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে প্রদত্ত ক্ষতিপূরণের আদেশের শতকরা ৫০ ভাগ অর্থ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির অনুকূলে জমা প্রদানসাপেক্ষে আপিল করতে পারবেন।

এতদিন অন্যান্য আইনের অধীনে পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হতো। দীর্ঘ আন্দোলনের পর সরকার পারিবারিক নির্যাতনকে চিহ্নিত করে আলাদা আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এই আইন যাতে সঠিকভাবে ব্যবহার হতে পারে সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া দরকার বিচার ব্যবস্থার। এই আইনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে নারীকেই। অন্যদিকে আইনের পাশাপাশি বাড়াতে হবে সমাজ সচেতনতা। পরিবর্তন আনতে হবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাহলে ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, সুদৃঢ় হবে সমাজে নারীর অবস্থান।

পারিবারিক সহিংসতামূলক ঘটনা দীর্ঘকাল ধরে চলে এলেও একবিংশ শতাব্দীর শেষপর্যায়ে বিষয়টি বৈশ্বিকপর্যায়ে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজবিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবেচনায় আসে। বাংলাদেশে যতরকম পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগের প্রত্যক্ষ শিকার নারী এবং পরোক্ষ শিকার শিশু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।

আরো পড়ুনঃ বাল্য বিবাহ কি ও এর প্রতিকার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের ৫৩ শতাংশ নারী ও গ্রামাঞ্চলের ৬২ শতাংশ নারী পরিবারে তাদের স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজন দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। জাস্টিস মেকার্স বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার। এর মধ্যে ১১ শতাংশ যৌতুকবিষয়ক নির্যাতন। তবে মাঠপর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা আরো নাজুক।

পরিবারে শিশু নির্যাতনের হার ক্রমেই বেড়েই চলছে তা সে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যেভাবেই হোক। এটি সর্বজনবিদিত যে, পারিবারিক নির্যাতনে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাবে তাদের মধ্যকার ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হয়। এতে একদিকে তারা মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে বেড়ে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

শুধু নিম্নবিত্তই নয়, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত নাগরিক সমাজের চার দেয়ালের মধ্যেও পারিবারিক সহিংসতার শিকার নিষ্পেষিত নারীর কান্না গুমরে ওঠে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, প্রকাশ্যে কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত এসব নির্যাতনের ঘটনা এখনো ব্যক্তিগত বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এমনকি আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিষয়টি পারিবারিক এবং ব্যাক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নেয়। ফলে নির্যাতনের শিকার নারী পুলিশ স্টেশন বা আদালতে যেতে তেমন ভরসা পায় না। কেননা সেখানেও তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি বা পুনরায় নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া সামাজিকভাবেও তারা বিভিন্নরকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে সব ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু নারীর অনগ্রসরতা বিবেচনায় ২৮ (৪) অনুচ্ছেদে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন আইন বা নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০। কেননা প্রচলিত আইনগুলোয় পারিবারিক সহিংসতা গুরুত্ব পায়নি এবং কোনোভাবেই এর প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সরাসরি শাস্তি পেতে হয়। ফলে সমঝোতার আগেই পরিবারগুলো ভেঙে যায়; যা পরিবার এবং সমাজের জন্য হুমকি। এ পর্যায়ে এমন একটি আইনের প্রয়োজন দেখা দেয়, যে আইনের মাধ্যমে পরিবারে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রণীত হয় পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এবং এর বিধিমালা ২০১৩।

পারিবারিক সহিংসতা আইন প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা :

এই আইন বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে :

১. পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ একটি নতুন আইন, তাই অধিকাংশ মানুষ এ আইন সম্পর্কে অবহিত নয়;
২. আইনটি কেবল পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য, তাই এটি খুবই স্পর্শকাতর;
৩. আদালত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রয়োগকারী কর্মকর্তাসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের যথাযথ সমন্বয়হীনতা;
৪. প্রচলিত আইন এবং সমাজব্যবস্থায় তৈরি পুরাতন এবং প্রচলিত মানসিকতা;
৫. পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও
৬. নারীর ক্ষমতায়নে বাধাগ্রস্ততা ইত্যাদি।

উপরোল্লিখিত প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য পারিবারিক পরিমন্ডলে নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার (যেমন: পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা) ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে; পারিবারিক সুরক্ষা আইন ২০১০ ও এর বিধিমালা ২০১৩ এর ওপর সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাধারণ জনগণ এই আইন বাস্তবায়নে এবং পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে এবং কমিউনিটিকে নারী ও শিশু অধিকার সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান এবং পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী আইনগুলোর বাস্তবায়ন মনিটর করার মাধ্যমে এ আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব।

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০-এর কার্যকর প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পারিবারিক সহিংসতার শিকার সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা আইনের আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এমনকি সহিংসতার ঘটনা পারিবারিক পরিমন্ডলে সংঘটিত হওয়ায় ও আইনটি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় অনেকেই আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে না। তাই আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিতদের জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া অত্যাবশ্যক।

তাছাড়া পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০-এ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার পাশাপাশি আদালত কর্তৃক আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে সারভাইভারের আস্থার জায়গাটি সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা এবং দ্রুততার সঙ্গে আইনি সহায়তা প্রদান করার যে কথা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এ আইনের কার্যকর প্রয়োগের লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে সরকার এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে এমন সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে আলোচ্য আইনটির পাশাপাশি অপরাপর আইনের মাধ্যমে প্রতিকারের উপায়গুলো জানিয়ে দিতে হবে। সর্বোপরি এ আইনের প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখার মাধ্যমে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে আইনের বাস্তবায়নে আরো সহজ-সরল কোনো নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষমতার মূল স্রোতধারায় নারীদের অংশগ্রহণ তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার মাত্রা কমে যাবে এবং নারীদের অবস্থানের উন্নতি হবে। একই সঙ্গে জাতীয় জীবনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমঅধিকার এবং সমান অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

দেশব্যাপী হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, নারী পাচার ইত্যাদির মতো ঘটনা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। বর্তমান সরকার এসব দমন বা নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করছে নানা পদক্ষেপ কিন্তু কিছুতেই কমছে না সহিংসতামূলক ঘটনা। এখন অনেক পরিবারের সদস্যও নিজ পরিবারে নিরাপদ নয়। অর্থাৎ দেশে অরক্ষিত পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। একের পর এক পারিবারিক সহিংসতার খবরে এখন অনেকেই ভীতসন্ত্রস্ত। এখন কথা হলো, নিজ পরিবারই যদি মানুষের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত স্থান না হয় তবে মানুষ যাবে কোথায়? বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে, পরিবারের সদস্য হচ্ছে মানুষের রক্ষাকবচের অন্যতম স্থান। তবে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার কারণে এখন আর এমনভাবে কিছুই বলা হচ্ছে না।

মানুষের জন্য পরিবার এমনই একটি জায়গা বা স্থান যার সদস্যরা একে অপরকে রক্ষা করে বিভিন্ন সমস্যা বা নিরাপত্তাহীনতা থেকে। সন্তানদের জন্য অন্যতম ভরসা হচ্ছে বাবা-মা। বিয়ের পর মেয়েদের জন্য অন্যতম নিরাপদ স্থান হয় স্বামীর ঘর। আর স্বামী-স্ত্রীর রক্ষাকবচ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ায় পরিবারের অনেকেই অনেক ব্যাপারেই এখন কেন নিরূপায়। এর মূল কারণ হলো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ইত্যাদি কমে আসছে। স্ত্রী সন্দেহ করছে স্বামীকে, স্বামী সন্দেহ করছে স্ত্রীকে, মা-বাবা সন্দেহ করছে ছেলেমেয়েকে। সন্দেহের প্রথম পর্যায়ে এর পরিণতি সম্বন্ধে তেমন কিছুই বুঝা যায় না। কিন্তু দিনের পর দিন তা গড়ায় চরম পরিণতির দিকে। অর্থাৎ এসব ক্রমেই সহিংসতায় রূপ নেয়। কিছুদিন আগে পারিবারিক দ্বনেদ্ব ঢাকার জুরাইনে দুই সন্তান পায়েল ও পাবনকে সাথে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন গৃহবধূ ফারজানা রীতা। এ নিয়ে অনেকদিন লেখালেখি হয়েছে পত্র-পত্রিকায়। দেশের সকল স্তরের মানুষ ঘটে যাওয়া এমন একটি পারিবারিক সহিংসতাকে ধিক্কার না জানিয়ে পারলো না। কয়েক দিন যেতে না যেতেই দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দিয়েছেন কমলাপুরে বিলাসী নামে এক গৃহবধূ। এ ধরনের ঘটনা হয়তো দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো ঘটছে, কিন্তু সব খবর তো আর মিডিয়া বা আইনের লোকের কাছে পৌঁছে না। না হলে হয়তো প্রতিদিনই এ ধরনের পারিবারিক সহিংসতার খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতো।

হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, নারী পাচার ইত্যাদির মতো অপরাধে শাস্তির বিধান দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩-এ থাকলেও পারিবারিক সহিংসতা ও পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট শাস্তির ধারা বা সুনির্দিষ্ট অপরাধের ধারা উক্ত দন্ডবিধিতে তেমনভাবে উল্লেখ নেই। যে কারণে অনেকে পারিবারিক সহিংসতা ঘটিয়ে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। এদের খুব একটা শাস্তির নজির দেখা যাচ্ছে না বলে ক্রমে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা। যা ক্রমে বাড়াচ্ছে সামাজিক সমস্যা। এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে।

উল্ল্যেখ্য, কতিপয় মানুষের অভিমত হচ্ছে যে, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন প্রকৃতপক্ষে তেমন কাজে আসবে না। কারণ প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা বা আটক করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য নয়। এতে করে হয়তো অনেক ধরনের ফাঁক-ফোকর থেকেই যাবে। পার পেয়ে যাবে প্রকৃত অপরাধীরা।

আজকের আর্টিকেলটি (পারিবারিক সহিংসতা কাকে বলে? আইন অনুযায়ী পারিবারিক সহিংসতা রোধের উপায়)  পছন্দ হলে শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দেয়ার অনুরোধ রইলো। আর যদি আপনাদের মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে তা নিচে কমেন্ট করেও জানাতে পারেন।

যে কোন আইনী পরামর্শের জন্যে যোগাযোগ করতে ইমেইল করুন -
Email: sylhetindependent@gmail.com
অথবা,
কন্টাক্ট বক্সে মেসেজ করতে পারেন।

Previous Post Next Post